সেরা অদম্য সাংবাদিক রোজিনা লং লিভ রোজিনা, লং লিভ ফ্রি প্রেস

সেরা অদম্য সাংবাদিক রোজিনা

লং লিভ রোজিনা, লং লিভ ফ্রি প্রেস

আনিসুল হক

আনিসুল হক

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১৩: ১৯

 

অ+অ-

 

রোজিনা ইসলাম, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন তিনি

রোজিনা ইসলাম, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন তিনিছবি: আশরাফুল আলম

কাজী নজরুল ইসলামের গানে আছে: ‘ফুলমালী! ফুলের শাখা কাটো যত পার, আহত সেই ফুল-শাখাতে ধরবে কুসুম আরো।’ রোজিনা ইসলামকে যত আঘাত করা হবে, তাঁর মহত্ত্ব তত বাড়বে, তত বাড়ছে। রোজিনা ইসলাম পেলেন সাংবাদিকতার অনেক বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কার, নেদারল্যান্ডসের ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড তাঁকে দিল ‘ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড ২০২১’, তাঁকে অভিধা দিল মোস্ট রেজিলিয়েন্ট সাংবাদিক বলে।

বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হয়রানি করা হয়েছে, তাঁর অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে, মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁকে শত বছরের পুরোনো ঔপনিবেশিক সিক্রেসি অ্যাক্টে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে—এসব যাঁরা করেছেন, তাঁরা সরকারের ভাবমূর্তিই শুধু ক্ষুণ্ণ করেননি, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করেছেন। এই সহজ কথাটা ‘অব দ্য রেকর্ড’ সরকারের লোকেরাই আমাদের বলেন। অন দ্য রেকর্ড টেলিভিশনের টক শোগুলোতে সব আলোচকই বলেছেন।

নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের সিটি হলে অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরের কাছ থেকে রোজিনা ইসলামের পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর স্বামী মনিরুল ইসলাম, ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন রোজিনা ইসলাম

নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের সিটি হলে অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরের কাছ থেকে রোজিনা ইসলামের পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর স্বামী মনিরুল ইসলাম, ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন রোজিনা ইসলাম

আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও আমাদের বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকেরা করলটা কী? কেউ বলেছেন, এটা একটা সাবোটাজ। কেউ বলেছেন, এটা একটা সরকারের ‘পাবলিক রিলেশন ডিজাস্টার’। শুধু পাবলিক রিলেশন ডিজাস্টার নয়, দেশের মানুষের মুখ নিচু করে দেওয়া আর আমি বলি, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় আটকে রাখা হয়েছে, সিএমএম আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন করা হলো, যখন আমি শুনলাম আজকে জামিন হবে না, তখন আমার মনে হলো, আমার মায়ের মুখখানিকেই মলিন করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা অনেকেই আমাকে কাঁদতে দেখেছিলেন। আমি আমার বোন, আমার সহকর্মী রোজিনার জন্য কাঁদিনি, আমার নিজের জন্য তো নয়ই, আমার মায়ের মুখ ওরা মলিন করে দিচ্ছে, এই এক চরম বেদনাবোধ আমাকে কান্নায় ভাসিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি সেদিন রোজিনা ইসলামের জন্য কাঁদিনি। রোজিনা ইসলামের জন্য আমরা গৌরববোধ করি। রোজিনা ইসলাম বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মুখ উজ্জ্বল করেন। রোজিনা ইসলামের রিপোর্টগুলো প্রমাণ করে, এই দেশে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম হয়! সেসব প্রকাশিত হলে কাজও হয়। সরকার বা প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। অ্যাকশন হয়। তাতে দেশের গণতন্ত্রই শক্তিশালী হয়। রোজিনাকে জেলে নেওয়া হলে রোজিনার মানহানি হয় না, রোজিনার ছোট্ট মেয়েটা কাঁদে; সকালবেলা মা ভ্যাকসিন নিতে বেরিয়েছেন, ব্যথাকাতর অবস্থাতেই তাঁর দ্বিতীয় কর্মস্থল সচিবালয়ে গেছেন, সেখান থেকে মা আর ফিরলেন না, আলভিনা অপেক্ষা করে, কেঁদে কেঁদে সারা হয়; অসুস্থ রোজিনা শারীরিক কষ্ট পান, মেয়েকে না দেখে মানসিক কষ্ট পান; কিন্তু তিনি তো অদম্য, তিনি তো মোস্ট রেজিলিয়েন্ট জার্নালিস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। তিনি দমে যান না। রোজিনার যেদিন জামিন হলো না, আদালতের পাশে পুলিশদের ....কক্ষে তাঁকে দেখতে আমি ভেতরে ঢুকলাম, তাঁকে একটা কথা বলেছিলাম, রোজিনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি পাকিস্তানি জেলে রাজা আনার খানকে দস্তয়ভস্কির লেখা ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন: ‘In the long war between the falsehood and the truth, falsehood wins the first battle and truth the last.’ সত্য আর মিথ্যার সুদীর্ঘ লড়াইয়ে প্রথমে জয়ী হয় মিথ্যা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সত্য। তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

আটকের পর আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় রোজিনা ইসলামকে। ১৮ মে ২০২১

আটকের পর আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় রোজিনা ইসলামকে। ১৮ মে ২০২১ছবি: সাজিদ হোসেন

রোজিনার জামিন হয়েছে। কিন্তু এখনো তিনি তাঁর অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ফিরে পাননি, মোবাইল ফোন ফিরে পাননি, পাসপোর্ট ফিরে পাননি। স্বাধীনভাবে চলাচল করার অধিকার, মৌলিক অধিকার। এটা কেড়ে নেওয়া যায় না। এইসব যাঁরা করছেন, তাঁরা যে দেশের ভাবমূর্তি আরও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছেন, তাঁরা কি তা জানেন? রোজিনা ইসলামের একেকটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয়, আর আমরা প্রশাসনের ভেতরের দুর্নীতির খবর জানতে পারি, সরকারই তাতে উপকৃত হয়, ব্যবস্থা নিতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সেই ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে’—এমন প্রতিবেদন তো কেবল রোজিনাই করতে পারেন। করোনার কালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর দপ্তরে দুর্নীতি–অনিয়ম কম হয়নি, এখন তো দুদকই মামলা দিয়েছে সাবেক মহাপরিচালকসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। রোজিনা ইসলাম একের পর এক প্রতিবেদন করে দুর্নীতির চিত্র খানিকটা তুলে ধরেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু যারা তাঁর প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা ছাড়বে কেন? তারাও দেখিয়ে দিয়েছে! এই দেখিয়ে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র! ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতা!

সারা বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সারা বাংলাদেশের মানুষ একযোগে রোজিনাকে হয়রানি করার এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সারা পৃথিবীর বিবেক নড়ে উঠেছে এবং প্রতিবাদী হয়েছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত বিবৃতি দিয়েছে। আমরা আস্থাবান হয়েছি, আমরা একা নই। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে: ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও॥ নয়কো বনে, নয় বিজনে নয়কো আমার আপন মনে...সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও॥’

আমাদের রোজিনা ইসলাম এখন পৃথিবীর মানুষ এবং সাংবাদিকতার প্রিয় হয়ে উঠেছেন। গত বছর যিনি নেদারল্যান্ডসের ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন, সেই ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা এবার শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের রোজিনা ইসলামও আমাদের হৃদয়ের নোবেল-শান্তি পুরস্কার বিজয়িনী।

প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আগামীকাল ৪ নভেম্বর। আর আজকে প্রথম আলো খুলেই এই সুসংবাদ। আমাদের রোজিনা বিশ্বসাংবাদিকতার বড় স্বীকৃতিটা পেয়েছেন।

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন রোজিনা ইসলাম

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার পেলেন রোজিনা ইসলামছবি: ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের টুইট থেকে নেওয়া

পুরস্কার নিতে রোজিনা নেদারল্যান্ডস যেতে পারেননি। যাবেন কী করে? তাঁর পাসপোর্ট তো জব্দ। কী গৌরবেরই না কথা! যাঁরা তাঁর পাসপোর্ট আটকে রেখেছেন, তাঁদের লজ্জা হচ্ছে না?

রোজিনা পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে জুমে বলেছেন, ‘আমি যা পেয়েছি, তা নিয়ে সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে যেতে পারি নিরাপদ বলয়ে। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি আমার কর্তব্য পালন করা হবে স্বাধীন সাংবাদিকতা করেই।’

শাবাশ রোজিনা। তিনি বক্তব্য শেষ করেছেন এই বলে: লং লিভ জার্নালিজম।

আহ! আমাদের মাথা আবারও উঁচু হলো। আমি দেশে-বিদেশে বলতে পারব, আমি সেই প্রথম আলোয় কাজ করি, চিনেছ তো, এই সেই প্রথম আলো, যেখানে কাজ করেন রোজিনা ইসলাম!

রোজিনা আমাদের মাথা উঁচু করে দিয়েছেন। আমরা যারা রোজিনার পাশে বসে কাজ করি, শুধু তাদের নয়, শুধু প্রথম আলোর সাংবাদিকদের নয়, শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী বাক্‌স্বাধীনতাকামী জনগণের নয়, বিশ্বের সব সাংবাদিকের, এবং সব স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখই তিনি উজ্জ্বল করলেন, মাথা উঁচু করলেন।

লং লিভ রোজিনা ইসলাম। লং লিভ ফ্রি প্রেস।