সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন গোষ্ঠী

সাক্ষাৎকার

সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন গোষ্ঠী

গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? রাষ্ট্রের নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, এসব প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক আন্দোলনে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।

ইমাম হোসেন সাঈদ

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২১, ১২: ২০

 

অ+অ-

 

ইকবাল সোবহান চৌধুরী

ইকবাল সোবহান চৌধুরী

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলার চেষ্টা করেছেন, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার এবং গণমাধ্যমকে মুখোমুখি করার চেষ্টা করছে। অথচ শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার দেশ চালাচ্ছে। এরপরও এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হচ্ছে?

ইকবাল সোবহান চৌধুরী: রাজনৈতিক সরকারের ভেতরেও দুষ্ট চক্র থাকে। যারা সুযোগ পেলেই নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। তবে এই চক্রের অপকর্মের দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর এসে পড়ে। দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে ইস্যু বা ঘটনা তৈরি করে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। আবার সরকারের ভেতরে থাকা রাজনৈতিক কোনো গোষ্ঠী বা ভিন্নমত পোষণকারীরাও নানা ঘটনা তৈরি করে সরকারের ক্ষতি করে। সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন। ফলে ওই মন্ত্রণালয়ের অনেকে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে বলেই মনে করি। হয়তো ফাঁদ পেতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছায় রোজিনা ইস্যু তৈরি হয়নি। মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ চক্র কাজটি করেছে। তারাই অভিযোগকারী, তারাই ঘটনার সাক্ষী, তারাই বাদী। রাজনৈতিক ইচ্ছায় হলে রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর জামিনের বিরোধিতা করত। সরকার খুব সূক্ষ্মভাবে ‘ইগো’ না নিয়ে তাঁর জামিনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার কখনো বলেনি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না। আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম–দুর্নীতির প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে সরকার কখনো বাধা দেয়নি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

প্রথম আলো: সাংবাদিককে কারাগারে পাঠাতে শত বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের প্রয়োগও এবার দেখা গেল। এর ফলে আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে, এ রকম কোনো ধারণা তৈরি হলো কি না।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী: সরকারের অনুমতি নিয়ে মামলাটি করা হয়েছিল কি না জানি না। মামলাটি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেদের দায়দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে গেছে এবং সরকারকে বিব্রত করেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কারও বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে কি না জানি না। সাংবাদিকতা কোনো গুপ্তচরবৃত্তি নয়। রোজিনা ইসলাম গুপ্তচরবৃত্তির কিছু করেননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য গোপনীয় কোনো তথ্য নয়। আর গোপন কোনো তথ্যের নথি টেবিলের ওপর পড়ে থাকবে কেন? মন্ত্রণালয় রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা করেছে, সেটি অন্যায়। কোন আইনে সেখানকার কর্মকর্তারা তাঁর মুঠোফোন জব্দ করেছেন? বেআইনিভাবে তাঁর ছবি–ভিডিও যাঁরা করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপন

প্রথম আলো: নানা মহলের আপত্তির পরও সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করেনি। এই আইনের কারণে একধরনের ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এটি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে চাপে রাখার সরকারি কৌশল কি না।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী: সাংবাদিকতা সব দেশেই ঝুঁকিপূর্ণ। আবার এটাও বাস্তবতা, সাংবাদিকেরা এর মধ্যেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমের কাজ সব সময় সত্য প্রকাশ করা। অনিয়ম–দুর্নীতির খবর তুলে ধরা। আইন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে দুর্নীতির খবর প্রচার বন্ধ করা যায় না। সাংবাদিকেরা ঝুঁকি নিয়েই অনুসন্ধান করেন। তাঁদের প্রতিবেদনে যে সত্য বের হয়ে আসে, তাতে মানুষ উপকৃত হয়। সরকারও সঠিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে, ব্যবস্থা নিতে পারে। ডিজিটাল আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। মামলা, গ্রেপ্তার করে বিচারের আগেই নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। এই আইন সংশোধন হওয়া দরকার। মানহানির মামলায় যেভাবে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে, ডিজিটাল আইনেও সে সুরক্ষা দিতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হলে গ্রেপ্তারের আগে সমন দেওয়ার বিধান যুক্ত করতে হবে। আর গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশের আইজি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমোদনের বিধান যুক্ত করতে হবে।
 

প্রথম আলো: ক্ষমতাবান ও আমলারা সাংবাদিকতার প্রতি একধরনের বৈরী মনোভাব পোষণ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় কি তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে?

ইকবাল সোবহান চৌধুরী: সব সময় ক্ষমতায় যারা থাকে, তারা সাংবাদিকদের ‘দায়িত্বশীল’ হতে বলে। আর বিরোধী দলে যারা থাকে, তারা বলে ‘সাহসী’ হতে। যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনিয়ম–দুর্নীতির খবরই গণমাধ্যমে বেশি প্রচারিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ‘শত্রু’ মনে করেন। তাঁরা সুযোগ খোঁজেন সাংবাদিকদের ঘায়েল করার জন্য। আর শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নন, বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে সাংবাদিকদের ওপর চাপ তৈরি করে। সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ না থাকায় বিভিন্ন গোষ্ঠী সুযোগ নিচ্ছে। এই অবস্থার অবসানের জন্য সাংবাদিকদের ঐক্য দরকার। বাধা এলেও নীতি–নৈতিকতা মেনে বস্তুনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করে যেতে হবে।